• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

সারা দেশ

কুষ্টিয়া খাদ্য অফিসের ভোল্ট থেকে ৬ মিলারের ২৩ লাখ টাকার সিডি গায়েব

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ৩০ আগস্ট ২০২৩

আকরামুজ্জামান আরিফ, কুষ্টিয়া:

কুষ্টিয়া জেলা খাদ্য অফিস থেকে মিল মালিকদের জামানত হিসেবে রাখা ২৩ লাখ টাকার সিডি উধাও হয়ে গেছে। খাদ্য অফিস থেকে গায়েব হওয়া এসব সিডির অর্থ ব্যাংক থেকে তুলেও নেওয়া হয়েছে। এদিকে খাদ্য অফিস থেকে কিভাবে মিল মালিকদের জামানতের সিডি গায়েব হয়ে গেল তা নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, অফিসের কয়েকজন কর্মচারীর সহযোগিতায় গোপনে এসব সিডি বাইরে এনে ব্যাংক থেকে ভাঙ্গিয়ে অর্থ তুলে নিয়েছেন কয়েকজন মিল মালিক। ২০২০ সালে সিডি গায়েবের ঘটনা ঘটলেও টের পাওয়া গেছে চলতি মাসে।

বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ৬জন মিল মালিকের নামে চিঠি ইস্যু করে তিন কার্য দিবসের মধ্যে জবাব দেওয়ার পাশাপাশি অর্থ জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি ৪ সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনার পর খাদ্য মন্ত্রনালয় গত ২৪ আগষ্ট সারা দেশের খাদ্য অফিসে চিঠি ইস্যু করে ২০২০ সালের ডিসির বিষয়ে তথ্য চেয়েছে। 

খাদ্য বিভাগ ও মিল মালিকদের একাধিক সুত্র জানিয়েছে, ২০২০ সালে করোনা চালাকালে মিল মালিকরা সরকারের সাথে চাল সরবরাহের চুক্তি করে। অন্য মিলারদের পাশাপাশি ব্যাপারী এগ্রো লি: ইফাদ অটোর রাইস মিলের দুটি প্রতিষ্ঠান, আল্লাহর দান রাইস মিল, হালিম অটো, জাহানারা এগ্রো ৬টি প্রতিষ্ঠান। প্রথম দিকে ৬টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪৬ লাখ  টাকার সিডি জমা ছিলো অফিসে। পরে আশিংক চাল দেওয়ায় আগের সিডি ফেরত দিয়ে ২৩ লাখ টাকার নতুন সিডি জমা রাখা হয় অফিসে। এর মধ্যে ইফাদ রাইস মিলের প্রায় ৯ লাখ টাকার চেক ছিল। ইফাদ অটো রাইস মিল দেউলিয়া হয়ে গেছে। ইফাদ অটো রাইস মিল ও ব্যাপারী আপন দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান।

২০২০ সালে সারা দেশে মিল মালিকদের জামানতের অর্থ সরকারের রাষ্টীয় কোষাগারে জমা করা হলেও শুধু মাত্র কুষ্টিয়া জেলায় জমা না করে অফিসে ফেলে রাখা হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালে ওই ছয় মিল মালিকের সাথে আঁতাত করে অফিসের তৎকালিন দারানোয়ান মামুন উর রশিদসহ অফিসের কয়েকজন কর্মচারী সিডি চুরি করে অর্থ তুলে ভাগাভাগি করে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

খাদ্য বিভাগ জানায়, চুক্তি মোতাবেক অনেক মিল মালিক চাল দিতে ব্যর্থ হন। এরপর খাদ্য মন্ত্রনালয় থেকে যেসব মিল মালিক পুরো চাল দিতে ব্যার্থ হয় তাদের জামানত আটকে রাখার নির্দেশ দেয়। সেই মোতাবেক মিল মালিকদের জামানত জেলা খাদ্য বিভাগ রেখে দেয়।

মিল মালিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, দীর্ঘদিন জামানতের অর্থ খাদ্য অফিসে পড়ে থাকায় লোকসানের কথা চিন্তা করে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বাবুল হোসেনের সাথে দেখা করে মিল মালিকরা জামানতের সিডির বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রনালয়ের সাথে কথা বলে একটা সুরাহা করার দাবি তোলেন।

বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সদ্য যোগ দেওয়া জেলা খাদ্য কর্মকর্তা বাবুল হোসেন যে সকল মিল মালিকদের সিডি জমা আছে তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন। তালিকা প্রস্তুত করার সময় দেখা যায় সেখানে ৬জন মিল মালিকের ২৩ লাখ টাকার সিডি নেই।

২০২০ সালে খাদ্য সংগ্রহের ফাইল দেখভাল করতেন অফিসের বড় বাবু তোফাজ্জেল হক। কথা হলে বলেন, আমি যখন বদলি হয়ে চলে আসি তখন মিলন নামের একজনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আসি। তিনি আমার কাছ থেকে সব বুঝে নিয়েছেন।

তবে মিলন আলী বলেন, ২০২০ সালে আমি দায়িত্বে ছিলাম না। পরের বছর আমি দায়িত্ব নিয়েছি। তখন সিডির বিষয়টি আমার জানা ছিল না।

২০২০ সালে সিডি খোয়া গেলেও তিন বছর ধরে তা চেপে রাখা হয়। চলতি মাসে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ওই ছয়জন মিল মালিককে চিঠি ইস্যু করার পাশাপাশি উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (কারিগরি) প্রবোধ কুমার পালের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রবোধ কুমার পাল বলেন, বিষয়টি আমি বিস্তারিত জানি না। কাজ চলছে।

বর্তমানে খাদ্য সংগ্রহের ফাইল সংরক্ষন ও দেখভাল করছেন খাদ্য বিভাগের অডিটর অনিক কুমার মজুমদার বলেন, আমাকে দায়িত্ব বুঝে দেয় মিলন আলী। তবে তিনি লিখিত ভাবে আমাকে কোন ফাইল বুঝে দিয়ে যায়নি। বিষয়টি সে সময় আমি স্যারকে জানিয়েছি। তবে সিডির বিষয়টি আমার জানা ছিল না।

এদিকে ৬টি মিলকে চিঠি দিয়ে উক্ত অর্থ তিন কার্য দিবসের মধ্যে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে খাজানগরে গিয়ে কথা হয় ব্যাপরী এগ্রো রাইস মিলের মালিক তোফাজ্জেল হোসেন ব্যাপারীর সাথে। এই তোফাজ্জেল হোসেন ও জাহানার রাইস মিলের মালিক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র যোগসাজসে খাদ্য অফিসের কয়েকজন কর্মচারী এ কাজ করেছে বলে খাদ্য বিভাগ সুত্র জানিয়েছে।

কথা হলে তোফাজ্জেল হোসেন ব্যাপারী বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা ঘটেনি। আমি কোন সিডি উত্তোলন করিনি। তবে আমার ছোট ভাই ইউনুস আলীর ইফাদ অটোর দুটি প্রতিষ্ঠানের সিডি নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। খাদ্য বিভাগ চিঠি পাঠিয়েছে।

হালিম অটো রাইস মিলের মালিক জহুরুল ইসলাম স্বপন বলেন, আমাদের সিডি খাদ্য অফিসে জমা ছিলো। সেই ডিসি হারিয়ে গেছে বলে শুনেছি। আমরাতো সিডির খবর জানি না। ব্যাংক থেকে কারা তুলে নিয়েছে সেটা জানা নেই। চিঠি পেয়েছি। দেখি কি করা যায়।’

আল্লাহর দান রাইস মিলের ম্যানেজার বলেন, গত কয়েকদিন আগে একটি চিঠি খাদ্য অফিস পাঠিয়েছে। সেই চিঠিতে কি আছে আমি জানি না। আমি চিঠিটি মালিককে দিয়ে দিয়েছি।

লিয়াকত রাইস মিলের মালিক হাজি লিয়াকত হোসেন বলেন, এটা বিশাল অনিয়ম। আমাদেরও লাখ লাখ টাকার সিডি অফিসে পড়ে আছে। আমরা অর্থ ফেরত পাচ্ছি না। অথচ অফিসের কিছু লোক অর্থের বিনিময়ে ভোল্ট থেকে সিডি চুরি করে সেগুলো মিল মালিকদের কাছে সরবরাহ করেছে। তাদের কঠোর বিচার হওয়া প্রয়োজন।

খাদ্য কর্মকর্তারা জানান, চাল সংগ্রহের আগে প্রতিটি মিল মালিকের সাথে সরকার চুক্তিবদ্ধ হয়। সরকারের নিয়ম অনুযায়ী যে পরিমান টাকার চাল মিল মালিক সরবরাহ করবে সেই টাকা ২ শতাংশ হারে জামানত রাখতে হয়। মিল মালিকরা ব্যাংক একাউন্টে নিদিষ্ট পরিমান অর্থ জমা দিলে সেখান থেকে একটি পে-অর্ডার দেওয়া হয়। চাল পুরোপুরি গোডাউনে দেওয়ার পর মিল মালিকরা আবেদন করলে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সেটি অবমুক্ত করেন। এরপর সেই অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নিতে পারেন মিল মালিকরা।

খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে গোপনে তদন্ত করে দেখতে পান সিডিগুলো কোন এক সময় অফিস থেকে বের করে আনা হয়েছে। সেই সিডি গুলো বের করে আনার পর ব্যাংকে ভাঙ্গিয়ে অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। এর সাথে সে সময়কার দারোয়ান মামুন উর রশিদসহ কয়েকজন মিল মালিক জড়িত।

দারোয়ান মামুন উর রশিদ বলেন, আমি সামান্য দারোয়ান। আমার পক্ষে সিডি বের করে এনে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন কি সম্ভব? বিষয়টি আমি জানি না।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বাবুল হোসেন বলেন, গত ২৩ আগষ্ট তারিখ মিল মালিকদের নামে চিঠি ইস্যু করে পাঠিয়েছি। তারা যেসব সিডি জমা দিয়েছিল তা ব্যাংক থেকে নগদায়ন করেছে বলে প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছি। তাই তাদের প্রমানাদি ও দলিলাদিসহ পেশ করতে বলা হয়েছে। না হলে তিন কার্য দিবসের মধ্যে অর্থ জমা দিতে বলা হয়েছে। তারা ব্যার্থ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অফিসের কেউ জড়িত আছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে কমিটি করা হয়েছে।’

চিঠি পাওয়ার পর জাহানারা রাইসের মালিক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আলী ব্যাংকে প্রায় ২ লাখ টাকার মত অর্থ জমা দিলেও বাকিরা দেয়নি বলে জানা গেছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads